Thursday, July 15, 2010

খোন্দকার আশরাফ হোসেনের কবিতা









ঘোর বর্ষা



বৃষ্টির ছাতা মাথায় নিয়ে নির্দ্বিধায় নেমে পড়ি রাস্তায়।
আর কোনো ভয় নেই, ভয়ের ডরটা পেরুতে পারলে।
অঝোর ধারাবর্ষণ এসে মুক্ত করে দিয়ে গেল আমাকে―
আহ্ শান্তি, আকাশজোড়া মুগ্ধ মানকচুর ছড়ানো পাতাটা
আমাকে রক্ষা করছে বৃষ্টিময়তার মধ্যে, ভিজিয়ে দিয়ে।

যে-মেয়েটি ট্রাফিক সিগন্যালে ফুল বেচে, ভিজছে সে-ও,
তার হাতে ধরা গোলাপের গোছা দুটো জল খেয়ে সতেজ;
এই তুমুল বৃষ্টির মধ্যে কেউ গাড়ির কাচ খুলবে না জেনেও
এসে দাঁড়াচ্ছে থেমে-যাওয়া গাড়ির পাশে, অভ্যাসমাফিক।

জল দাঁড়ায়ে গেছে টাকনু তক, পানির হালট ভেঙে ওপারে
হেঁটে গেলেন পাজামা-গোটানো এক মৌলবী সাহেব।
কালস্রোতে ভেসে যাওয়া ধনমান লক্ষ করে বিষণ্ন এক পাগল
ভেজা কাকের সাথে অঝোরে ভিজতে থাকে চৌমাথায়।

রমনার গাছগুলো শতাব্দীর ঘুম-ভাঙা কলহে মেতেছে
বাবড়ি চুলের সাথে দীর্ঘ কেশদাম লুটোপুটি হাওয়ায় হাওয়ায়
ঝরাপাতা সাঁতার কাটছে তেলাপিয়া মাছ, প্রেমপত্র,
পরিত্যক্ত ঠোঙার সাথে জীবনের শেষ চিকিৎসার হ্যান্ডবিল ।

এত প্রাণ এত দু:খ এত নিরাভরণ দীনতা ও ক্ষুধা
সব ঐ নিরন্ধ্র বৃষ্টির মধ্যে মনে হয় হারিয়েছে ধার
সবকিছু ক্লান্তির অপর পারে আবছায়া ধূসরতা মৃত্যুমলিনতা
ঢেকে রাখে ক্রোধ, প্রেম, অহোরাত্র কলহের মানকচুপাতা।



ঘন বর্ষার দিনে কাচারিঘরের মধ্যে নানান দৃশ্যের জন্ম,
বাঁশের চাঙারি বানাচ্ছে কেউ, ফুটে উঠছে ডেভিডের তারা চাচড়ের ক্রসবুনোটে
কোন এক নাজেহাল শহর ভ্রমণের গল্প বলছে হাতফেরতা হুঁকা
সেবার মাছের ঝাঁক উঠে এসেছিল আউশের ক্ষেতজুড়ে খণ্ডকালীন মাছুড়েরা বলে
টেটা বল্লম হাতে ওয়াটারলু’ যুদ্ধের স্মৃতি কয়েকজন প্রাক্তন সেনার।

এদিকে হৈ হৈ পাঁচটি কিশোর বাতাবিনেবুর ওয়ার্লডকাপে
কাকেরা ভেজা ডালের মোরাকেবায় প্রসন্ন, কেউ কেউ হীনযানী অতন্দ্রচাক্ষুষ
কাদার ভেতর থেকে উজানি কৈয়ের হৃদি করতলে ধরে যেন বুদ্ধের যৌতুক।

ঘনবর্ষার দিনে তাসের আসরে সব টুয়েন্টি-নাইন -রঙ কল্পনার ধনু
আছাড়ি-পিছাড়ি যায় কিষাণীর জলভেজা কষ্ট শাড়ি নিঙাড়ি নিঙাড়ি।

কারো-কারো মনে পড়ে কে যেন পদ্মার বোটে ভেসেছিল দূরদেশি বাবু
দেখেছিল ছাতিমের উদার পাতার নিচে ভিজছে পিতৃগৃহষ্ণেু নায়রী
এবার হলো না গান সাজাদপুরের হাটে বিষয়ীরা ডুবিয়েছে নাও
বেহদ্দ পানির দরে পাট বেচে ঘরে ফেরে উদাস লালন ।

৩.

আকাশের জলকরঙ্কবাহীরা সারি সারি দাঁড়ায়ে গিয়েছে
আর ঢালছে তাদের কুম্ভ থেকে জল,
নিচে মানুষের সাধ্যমত ঘরবাড়ি, ধানক্ষেত, পালানের নামিলা মরিচ
ভেসে যাচ্ছে পানিয়া ভরনে নদীতীর উথালিপাথালি যায়
বাইচের নৌকা আর কলার ভেলার চলে সমতুল নওরোজ, ফেটিবাঁধা
গায়েনের দোহার ধরেছে মালকোচা পরনে কিশোর
কচুরিপানার ঘূর্ণি ঢোঁড়াসাপের হৃদয় কাড়িছে
হেঁকে যায় বজ্রের চাবুক হাতে তুড়–ক সওয়ার
জলের সিন্ধুক খুলে কী কী রত্ন পাওয়া যায় দেখে নেয় জেলে
উপরে টিনের বাদ্য ঝমাঝম বৃষ্টির নাচুনি
থামালে কত্থক নাচ একটুখানি টুসকি দেয়ে সোনার ছেলেরা



কবি পরিচিতি
খোন্দকার আশরাফ হোসেন : কবি প্রবন্ধকার ও সম্পাদক--একবিংশ। প্রফেসর, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments:

Post a Comment