আজ বৃষ্টি ঝরছে। শুনছি, শাওনগগণে ঘোর ঘনঘটা। কণিকা কিন্নর কণ্ঠে গাইছেন। রাত্রি নয়--নিশীথ নেমে এসেছে। বজ্রবিদ্যুতের মধ্যে দিয়ে রাধা চলেছেন বনপথে। গাছপালা লটিয়ে আছে। প্রবল হাওয়ায় যমুনা ফুঁসে উঠেছে। কোথাও বাজছে বাঁশি। আর ঝরছে যুথিগন্ধ বৃষ্টি। এই ছবিটি আমার শ্রাবণের। তবু শ্রাবণদিন চলে যায়। কেবল তার ছায়া পড়ে থাকে মনে--বনে।
এরকম শ্রাবণ নিয়ে কবিতা লিখেছেন ছয়জন কবি। প্রতিটি কবিতায়ই ভীন্নস্বর বাজে। শব্দের গায়ে মেঘ জমে। বৃষ্টি নামে।
বৃষ্টির ছাতা মাথায় নিয়ে নির্দ্বিধায় নেমে পড়ি রাস্তায়। আর কোনো ভয় নেই, ভয়ের ডরটা পেরুতে পারলে। অঝোর ধারাবর্ষণ এসে মুক্ত করে দিয়ে গেল আমাকে― আহ্ শান্তি, আকাশজোড়া মুগ্ধ মানকচুর ছড়ানো পাতাটা আমাকে রক্ষা করছে বৃষ্টিময়তার মধ্যে, ভিজিয়ে দিয়ে।
যে-মেয়েটি ট্রাফিক সিগন্যালে ফুল বেচে, ভিজছে সে-ও, তার হাতে ধরা গোলাপের গোছা দুটো জল খেয়ে সতেজ; এই তুমুল বৃষ্টির মধ্যে কেউ গাড়ির কাচ খুলবে না জেনেও এসে দাঁড়াচ্ছে থেমে-যাওয়া গাড়ির পাশে, অভ্যাসমাফিক।
জল দাঁড়ায়ে গেছে টাকনু তক, পানির হালট ভেঙে ওপারে হেঁটে গেলেন পাজামা-গোটানো এক মৌলবী সাহেব। কালস্রোতে ভেসে যাওয়া ধনমান লক্ষ করে বিষণ্ন এক পাগল ভেজা কাকের সাথে অঝোরে ভিজতে থাকে চৌমাথায়।
রমনার গাছগুলো শতাব্দীর ঘুম-ভাঙা কলহে মেতেছে বাবড়ি চুলের সাথে দীর্ঘ কেশদাম লুটোপুটি হাওয়ায় হাওয়ায় ঝরাপাতা সাঁতার কাটছে তেলাপিয়া মাছ, প্রেমপত্র, পরিত্যক্ত ঠোঙার সাথে জীবনের শেষ চিকিৎসার হ্যান্ডবিল ।
এত প্রাণ এত দু:খ এত নিরাভরণ দীনতা ও ক্ষুধা সব ঐ নিরন্ধ্র বৃষ্টির মধ্যে মনে হয় হারিয়েছে ধার সবকিছু ক্লান্তির অপর পারে আবছায়া ধূসরতা মৃত্যুমলিনতা ঢেকে রাখে ক্রোধ, প্রেম, অহোরাত্র কলহের মানকচুপাতা।
২
ঘন বর্ষার দিনে কাচারিঘরের মধ্যে নানান দৃশ্যের জন্ম, বাঁশের চাঙারি বানাচ্ছে কেউ, ফুটে উঠছে ডেভিডের তারা চাচড়ের ক্রসবুনোটে কোন এক নাজেহাল শহর ভ্রমণের গল্প বলছে হাতফেরতা হুঁকা সেবার মাছের ঝাঁক উঠে এসেছিল আউশের ক্ষেতজুড়ে খণ্ডকালীন মাছুড়েরা বলে টেটা বল্লম হাতে ওয়াটারলু’ যুদ্ধের স্মৃতি কয়েকজন প্রাক্তন সেনার।
এদিকে হৈ হৈ পাঁচটি কিশোর বাতাবিনেবুর ওয়ার্লডকাপে কাকেরা ভেজা ডালের মোরাকেবায় প্রসন্ন, কেউ কেউ হীনযানী অতন্দ্রচাক্ষুষ কাদার ভেতর থেকে উজানি কৈয়ের হৃদি করতলে ধরে যেন বুদ্ধের যৌতুক।
হাত ধরে আছি বাঁশপাতা কাপড়ের গম্বুজে ধুম করে ঢুকে যাচ্ছে জলমর্মর পিচ্ছিল মাটিদেশ নামছে মেঘপতনের আলো - আকাশের বিষ্ময়! গুঁড়ি গুঁড়ি এই প্রীতিখণ্ড বাতাস ধরে উঠছে কোন হিমালয়ে!
কালো মহিষের বেশে দৌড়াচ্ছে মানুষের ছায়া পেছনে জড়ানো এই গ্রামদেশ কার বার্তা পাঠায় কাকে জানায় অপহরণের ঘটনা? নির্বিবাদী জলআক্রমণে শেষ হয় পাথরকুড়ানোর আশা আর দূরে যাওয়ার যাতনা গলে যায় এই ব্যাকুল মহিলার মৌসুমে। নুয়ে আছি ছেলেদের লালবলে- ভিজে যাওয়া গোলপোস্ট ধু ধু মাঠে, নিজেকে হারাই- গোলাকার নিরাকার কক্ষপথে।
১২/০৭/২০১০
ছাতার নিচে-- দুই
ভাষার ব্যবহার ছোট হয়ে যায় শরীরে জমে জলপাখি মেঘের পিঞ্জর আসে প্রস্তরযুগ শিকারির ইশারা দখল করছে কেউ এই ব্রীজ পারাপার লেবুপাতার সংসার।
তরল পতনে নিজের পায়ে দাঁড়ানো দায়! ধান দুর্বা ধুলি যাই দিই আজ শুধু বিবতর্নের প্রাণ ছাড়া কিছুই নাই। যদি সংশয়ে থাকো তাহলে ছাতার ভেতরে আসো, দেখে যাও নীলসবুজ সময়ের কামিজে নীড়হারাদের ঠিকানা।
প্রতীক্ষার পালন শেষে জেগে উঠেছে মুহূর্ত বৃষ্টি বৃষ্টি শাদা-সন্ত পায়রার দল দেবদূত উড়ছে বাস স্টপ রেলের কামরায়। নিহত সিপাহিদের দল কালো কাপড়ে ঢেকে যায় রক্তপিপাসা।
১২/০৭/২০১০
কবি পরিচিতি আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ : কবি। শিক্ষক। অস্ট্রেলিয়ায় বসবাসরত। জন্ম : ১৯৬৫।
ঝাপসা হয়ে আসছে চোখ, তোমাকে কীভাবে বলি তোমার দিকেই আমি ক্রমশ শ্রাবণ! শব্দে শব্দে মেঘ করে আসে... ভিজে মাটির উপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে একবুক শ্বাস আমার প্রেমের মত ওঠে নামে, শান্ত সোঁদা মাটির ভাষায়
২. আকাশে কান্নার মুখ ভার নিচু মেঘ জানে না সে কীভাবে আষাঢ় যেমন আমার মন যেমন তোমার মন ভীষণ একাকী...
আকাশে কান্নার মুখ ভার
৩. যাব না কোথাও, এই শহরে মেঘের তাবু থেকে... বলব না আমাকে নাও আলো যত কমে আসে, আমারও বয়স ক্লান্ত হয় এস তুমি আমাকে ভেজাও অনেক মৃত্যুর গল্পে পুনরুজ্জীবনের কথা থাকে শ্রাবণ, ভাসাও বৃষ্টির ফোঁটা নিচে বুড়ো পাতা শেষ কয়েকদিন যেমন ছটফট করতে থাকে
* হিন্দোল ভট্টাচার্য : কবি। সহসম্পাদক--থিয়েটার ম্যাগাজিন স্যাস,কোলকাতা। জন্ম ১৯৭৭।
মাঠের এ-আল থেকে ও-আল, ও-আল থেকে হেঁটে গেলে দূরে, ও..ই দূরে যেখানে একটি তালগাছ--একটি গাঁয়ের শুরু, ঝিঁঝির কোরাস দীর্ঘ কুহকী পাখির ডাক, বাদুড়ের ডানা ঝাপটানো শব্দ একাকার করে মোচড়ে মোচড়ে উঠে আসে হাওয়ার গোঙানি শুধু তালগাছের মাথার 'পর ছোপ ছোপ কালো মেঘ ... ...
ওরে ঐ মেঘ করেছে--বৃষ্টি হবে!
এক ব্যাপ্ত উল্লাসে ঘুমের পাথার ভেঙে জেগে ওঠে কেশব ঘরের দাওয়ায় দেখে মাতাল আকাশ তেজী মেঘ হাওয়ার সংঘর্ষে ঘনীভূত, কী দ্রুত মিশে যেতে থাকে কলার উচ্ছ্বল ঝাড়ে দূ..র গাঁয়ে বৃষ্টির গর্জন, শোঁ শোঁ শব্দ ...
ওই শব্দে ঘোরে ফেরে হাজার আকুতি যত স্বপ্ন সাধ :
প্রচণ্ড খরায় গেছে বৃথা ওই চৈত্র ও বৈশাখ--যাক এবার বৃষ্টিটা হলে হয়! ক্ষুধার আদিম আয়োজনে ফুঁসে ওঠে হাতে পেশী, পায়ে শিরা দেহে কাদাজল বিন্দু বিন্দু ঘাম, মুখে হাসি স্বস্তির নিঃশ্বাস এবারে ফসল হবে ... কুসুমের জন্য লালপেড়ে একখান শাড়ী, আনকোরা ঘ্রাণ নবান্নের উৎসব, ধানকাটা মাঠে যাত্রা, কবিগান, ধূয়া জারী সারী এবারে বৃষ্টিটা হলে হয়!
দূর গাঁয়ে ততক্ষণে বৃষ্টি হয়ে গেছে।
ভারী শব্দে ওই জোর বৃষ্টি উড়ে আসে এইবার তালবনে আধিভূত অন্ধকারে একবার ঝপ ঝপ ঝরে পড়ে ঝাপসা করে চলে যায় গাঁয়ের ওপ্রান্ত থেকে এপ্রান্ত, এপ্রান্ত থেকে আরো দূর প্রান্তপুর সকল সীমান্ত ছুঁয়ে ওগরানো পোড়ামাঠ চাপ চাপ মাটি ঘাস, অগণিত আলের বিরোধ ধুয়ে যায় একবার সে'তো শুধু একবার ... ... তারপর উড়ে যায় দূরে, কোন অভিশপ্ত জনপদ, বিরাণ প্রান্তরে
হায় বৃষ্টি!
আবেশে উল্লাসে সারারাত ঝরে যাবে বলে ভিজে ভিজে মাটি এই কুমারী দেহের মত কম্পিত হবে বলে পেশল বাহুতে লাঙলের উদ্দাম উৎসব শুরু হবে বলে মধ্যরাতে গহীন আঁধারে চেয়ে থাকা ... ...
হাওয়ায় হাওয়ায় কাপুরুষ কালো মেঘ সরে আসে প্রতারক হাসি হেসে ওঠে চাঁদ, শুধু শুয়ে থাকে নীচে বন্ধ্যা নারী এক এপাশ ওপাশ ফেরে।
*কবি পরিচিতি তুষার গায়েন : কবি, প্রাবন্ধিক। আর্কিটেক্ট। জন্ম ১৯৬৭।