Friday, September 3, 2010

মিউটেশনঃ মানবদেহ এবং উদ্ভিদে তার প্রভাব ও প্রয়োজনীয়তা

মাহমুদা নাসরিন কাজল

মিউটেশন কি?
কোন জীবের এক বা একাধিক বৈশিষ্টের আকস্মিক বংশগত পরিবর্তনকে মিউটেশন বলে। স্থুল অর্থে কোন জীবের কৌলিক বস্তুর (genetic material) যে কোন পরিবর্তন যেমন- ক্রোমোজোমের গঠনগত পরিবর্তন, সংখ্যাগত পরিবর্তন বা জীনের গঠনগত পরিবর্তন ইত্যাদি সকল প্রকার পরিবর্তনকেই মিউটেমন বলে বিবেচনা করা হয়। সূক্ষার্থে, জীনের ক্ষারক বিন্যাসের পরিবর্তনকেই মিউটেশন হিসেবে ধরা হয়। জীনের এ জাতীয় মিউটেশনকে পয়েন্ট মিউটেশন বলা হয়।

এই রকম পরিবর্তনের ফলে কোন জীবে নতুন ধরনের চরিত্র দেখা দিতে পারে। এই চরিত্র উত্তরাধিকারসূত্রে এক বংশ থেকে পরের বংশে যায়। কোন জীবের বৃদ্ধির সময় প্রত্যেক জীন অসংখ্যবার বিভক্ত হয়। সাধারনত এইসব বিভাজন যথাযথভাবে হওয়ার ফলে অপত্য জীনগুলি মাতৃজীনের অনুরুপ হয়। কিন্তু আকস্মিকভাবে কোন বিভাজনের সময় গোলযোগ দেখা দিলে পরিবর্তিত অপত্য জীনের সৃষ্টি হতে পারে। এর এটাই মিউটেশন।

মিউটেশন কি কি কারনে হতে পারে?
প্রথমত মিউটেশন দুই রকমের। একটা হল স্বতঃস্ফুর্ত (Spontaneous) মিউটেশন যা নানাবিধ প্রাকৃতিক কারণে হয়। যেমন-সুর্যের বিভিন্ন রশ্মি (গামা রশ্মি, বিটা রশ্মি, এক্স রে, আলট্রা ভায়োলেট রে), বিভিন্ন পারমানবিক রশ্মি, তেজস্ক্রিয় পদার্থ থেকে বিকিরিত বিভিন্ন রশ্মি, অধিক তাপমাত্রা ও বিভিন্ন রোগ আক্রমণের ফলে এমনকি দীর্ঘদিন স্টেরয়েড বা এ জাতীয় কোন ওষধ সেবন করলে এ ধরনের মিউটেশন ঘটতে পারে। স্বতঃস্ফুর্ত মিউটেশনের হার অত্যন্ত কম। সাধারণত প্রতি ১০,০০০ থেকে ১০০,০০০ গ্যামেট বা কখনো কখনো ১০০০,০০০ গ্যামেটের মাত্র ১টি গ্যামেটে মিউটেশন হয়ে থাকে (উদ্ভিদ প্রজনন,শহিদুর রশীদ ভূইয়া, ১৯৯২)।

অধিকাংশ মিউটেশনই ক্ষতিকর এবং গাছের জন্য তা মৃত্যুর কারণ হতে পারে। তবে কখনো কখনো মিউটেশনের ফলে অনুকূল চরিত্রের সৃষ্টি হয়। ক্ষতিকর মিউটেশনযুক্ত জীব স্বাভাবিক জীবের সাথে প্রতিযোগীতায় অকৃতকার্য হয়ে বাতিল হয়ে যায়। কারন প্রকৃতি সব সময় অনুকুল চরিত্র যুক্ত জীবকে নির্বাচিত করে। সাধারনতঃ মিউটেশনের ফলে কোন জীবের প্রাণশক্তি কমে যায়। আবার কোন কোন মিউটেশনের ফলে জীব অনুর্বরও হয়ে উঠতে পারে।

দ্বিতীয়টা হল আবিস্ট বা induced মিউটেশন যা বিভিন্ন মিউটাজেনিক এজেন্ট প্রয়োগের মাধ্যমে এ ধরনের মিউটেশন ঘটানো হয়। উদ্ভিদে জেনেটিক ভেরিয়েশন সৃষ্টি করে প্রজননের কাজ এগিয়ে নেয়ার জন্য এ ধরনের মিউটেশন ঘটানোর প্রয়োজন পড়ে।

মানবদেহে মিউটেশন হয় কি?
........................................................
মানুষের ক্ষেত্রে বলা যেতে পারে- যদি দীর্ঘদিন ধরে কোন জীবন্ত মানবদেহ উপরোক্ত প্রাকৃতিক কারণসমুহের সংস্পর্শে একনাগাড়ে থাকে তাহলে তার দেহের জীন লেভেলে মিউটেশনজনিত পরিবর্তন ঘটতে পারে যা তার দেহে বিভিন্ন জটিলতার জন্ম দিতে পারে (ক্যানসার, টিউমার বা এজাতীয় সমস্যা) যা থেকে মৃত্যুও হতে পারে বা তার চরিত্রগত কোন পরিবর্তন এনে দিতে পারে যা কিনা সে তার পুর্বপুরুষ থেকে পায়নি। অথচ মিউটেশনের কারণে পরিবর্তিত এই চরিত্রটি তার পরবর্তী বংশধরে ঠিকই স্থানান্তরিত হবে। কেননা এই পরিবর্তনটি ঘটেছে জিন লেভেলে। মিউটেশন যুক্ত কোষ থেকে সৃষ্ট সব কোষেই মিউটেশন থাকে। এক জেনারেশনে ঘটে যাওয়া মিউটেশন সে জেনারেশনে প্রকাশিত নাও হতে পারে যদি তা রিসিসিভি (প্রচ্ছন্ন) হয়। পরবর্তী কোন জেনারেশনে তা ডমিন্যান্ট (প্রকট) রুপে প্রকাশিতও হতে পারে।
বলাই বাহুল্য- স্বতঃস্ফুর্ত মিউটেশনের হার অত্যন্ত কম।

মানুষর বেলায় Spontaneous মিউটেশন এর একটা প্রধান কারণ হতে পারে তার খাদ্যাভ্যাস, নানা ঔষধ ইত্যাদি। চিকিৎসার প্রয়োজনে ঘন ঘন এক্সরে করা এবং অযোগ্য ও অল্প জ্ঞনসম্পন্ন টেকনিশিয়ান দ্বারা এক্সরে করানো, কৃত্রিমভাবে বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্য দ্বারা সংরক্ষিত ও পাকানো সব্জি, ফল, মাছ, দুধ ইত্যাদি খাওয়া কারণে মানবদেহের বিভিন্ন স্তরে বিভিন্ন পরিবর্তন ঘটছে যা আমাদের সমাজে দৃশ্যমান।

ভারতীয় জেনিটিসিস্ট সুহিতা গুহের মতে, যারা খুব বেশী কফি বা চা পান করেন তাদের দেহে যথেস্ট পরিমাণে ক্যাফিন সঞ্চিত হয়ে মিউটেশনের কারণ হিসেবে দেখা দিতে পারে। যারা বেশী ধুমপান করেন তাদের দেহে যথেষ্ট শক্তিসম্পন্ন মিউটেশন সৃষ্টিকারী পদার্থ নিকোটিন ক্ষতির কারণ হতে পারে। এছাড়া বিভিন্ন খাদ্য সংরক্ষণকারী পদার্থ (Preservative), কোন কোন ঔষধ (যেমন বিটা প্রপিয়ো ল্যাকটিন), সরষের তেল, বাদাম তেল, রেড়ির তেল এমনকি মদও মিউটেশনের কারণ হতে পারে। সরষের তেলের allylisothiocyanate এ মিউটেশন সৃষ্টিকারী পদার্থ পাওয়া গেছে। মদ তথা ইথাইল অ্যালকোহল দেহে প্রবেশ করে মিউটেশন সৃষ্টিকারী পদার্থ অ্যাসিটালডিহাইডে পরিবর্তিত হতে পারে।

মানুষে কোমোজোমের মিউটেশনের প্রভাবঃ
.....................................................
মানুষে ক্রোমোজোমের সংখ্যার বা গঠনগত তথা আকৃতির পরিবর্তনের জন্য নানা রকম অস্বাভাবিকতা দেখা দেয়। সাধারনত মানবদেহে ক্রোমোজোম সংখ্যা ২৩ জোড়া (৪৬টি)। ২২ জোড়া দেহকোষীয় যাদেরকে বলে অটোজোম এবং এক জোড়া প্রজননকোষের, এদেরকে বলে সেক্স ক্রোমোজোম। সেক্স ক্রোমেজোম আবার স্ত্রী প্রজাতিতে xx রুপে এবং পুরুষ প্রজাতিতে xy রুপে বিদ্যমান থাকে।

বিজ্ঞানীদের গবেষণায় জানা যায় যে, ক্রোমোজোমীয় অস্বাভাবিকতার জন্য মানুষের নানা রকম রোগ দেখা দিতে পারে। একুশতম ক্রোমোজোম একটা অতিরিক্ত থাকলে মানুষে mongolism বা Down’s syndrome সৃষ্টি হয়। xxy ক্রোমোজোম বিশিষ্ট লোকে kleinfelter’s এবং xo ক্রোমোজোম বিশিষ্ট লোকে turner’s syndrome দেখা দেয়।

mongolism বা Down’s syndrome : এদের ক্ষেত্রে দেহের প্রায় সব টিস্যুতেই কম বেশী অস্বাভাবিকতা দেখা যায়। এদের চওড়া ছোট মাথা, বাঁকা চোখ, চ্যাপ্টা নাক, বড় জিভ, ছোট ছোট হাত-পা থাকে। এদের বুদ্ধিও খুব কম থাকে। এছাড়া এরকম লোকেদের নানারকম রোগ যেমন-ক্যাটার‌্যাক্ট, হৃদরোগ, হার্নিয়া, শ্বাসযন্ত্রের রোগ ইত্যাদি বেশী হয়। অস্থি মজ্জায় রক্ত সৃষ্টিকারী কোষে (Stem cell) অটোজোমীয় ক্রোমোজোমের ঘাটতির কারণে ক্রনিক গ্রানুলোসাইটিক লিউকেমিয়া দেখা দেয়।
kleinfelter’s syndrome : এ অবস্থা সাধারণত পুরুষদের বেলায় ঘটে। এদের বদ্ধি কম থাকে। তবে এরা এগ্রেসিভ, রুক্ষ ও উগ্র মেজাজী হয়। এরা সমাজ বিরোধী ও অপরাধপ্রবণ হয়। সহজেই সন্ত্রাসী কর্মকান্ণ্ডের সাথে এরা সম্পৃক্ত হয়ে যায়।

turner’s syndrom : এ অবস্থা সাধারণত স্ত্রীদের বেলায় দেখা যায়। turner’s syndrome বিশিস্ট স্ত্রীতে কেবল একটা x ক্রোমোজোম থাকে। প্রতি ৩০০০ জনের মধ্যে একজনের এ রোগ হয়। এদেরও বদ্ধি স্বাভাবিকের তুলনায় কম থাকে। এদের ব্রেস্ট এর গঠন ঠিকমত হয় না। হিজড়া ও মানসিক প্রতিবন্ধিত্ব একারণে হতে পারে।

কৃত্রিম মিউটেশনের গুরুত্বঃ
বিভিন্ন উদ্ভিদ ও প্রানীর উন্নতিকল্পে কৃত্রিম উপায়ে সুবিধাজনক মিউটেশন সৃষ্টি করার চেষ্টা করা হয়। এভাবে অনেক ক্ষেত্রে উৎপাদন ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো সম্ভব হয়েছে। ছত্রাক থেকে মুল্যবান ঔষধ পেনিসিলিন তৈরী হয়। এই ঔষধ যখন প্রথম আবিস্কৃত হয় তখন ছত্রাক থেকে খুব কম পরিমাণে ঔষধ পাওয়া যেত। পরে বিকিরণ প্রয়োগ করে এমন ছত্রাক পাওয়া গেছে যার উৎপাদন ক্ষমতা অনেক বেশী। বিজ্ঞানী H. Stubbe দেখিয়েছেন, মিউটেশনের মাধমে উৎপাদিত বার্লির উৎপাদন ক্ষমতা ও প্রেটিনের পরিমাণ বেশী। আমেরিকায় চিনাবাদাম গাছে এক্সরে প্রয়োগ করে অধিক উৎপাদনশীল গাছ পাওয়া গেছে। M.S. Swaminathan গমে আলট্রা ভায়োলেট ও গামা রশ্মি প্রয়োগ করে দ্রুত ফলনশীল ও অধিক প্রোটিনযুক্ত উদ্ভিদ পেয়েছিলেন। এই উদ্ভিদে লাইসিনের পরিমাণ বেশী হয়। এছাড়া সর্ষে গাছে তেলের পরিমাণও মিউটেশনের মাধ্যমে বাড়ানো সম্ভব হয়েছে।
স্বপরাগী উদ্ভিদে বিশেষত যে সব উদ্ভিদে সহজে সংকরায়ণ করা যায় না তাদের বেলায় কৃত্রিম উপায়ে মিউটেশনের মাধ্যমে উন্নতি করা সম্ভব (পাট)। মিউটেশনের মাধ্যমে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বাড়ানো সম্ভব হয়েছে (চীনাবাদাম)। মিউটেশনের মাধ্যমে বিভিন্ন ফলের উৎকর্ষ সাধন হয়েছে (বীট)। ফুলে বৈচিত্র সৃষ্টি করা হয়েছে (ডালিয়া)।

বাংলাদেশে মিউটেশন এর অবদানঃ
বাংলাদেশ আনবিক কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা) আমাদের দেশে প্রবর্তিত আই আর-৮ জাতে এবং দেশী জাত নাইজারশাইলে গামা রশ্মি প্রয়োগ করে যথাক্রমে ইরাটম-২৪ ও বিনাশাইল নামক দুটি উন্নত জাত উদ্ভাবন করেছে। বিনা থেকে একই প্রক্রিয়ায় ফরিদপুর-১ নামক ছোলাতে গামা রশ্মি প্রয়োগ করে উচ্চ প্রোটিনসমৃদ্ধ হাইপ্রোছোলা নামক নতুন জাতের ছোলা ও পাটের ডি-১৫৪ জাতে গামা রশ্মি প্রয়োগ করে উফসী এটম পাট-৩৮ জাত সৃষ্টি করা হয়েছে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে সরিষাতে রাসায়নিক দ্রব্য প্রয়াগ করে সম্বল নামক রাই সরিষার একটি জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে।

শেষ কথাঃ
যারা বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্ডারগ্রাজয়েট এবং পেস্ট গ্রাজুয়েট পর্যায়ে পাটোয়ারী স্যারের ক্লাস পেয়েছেন তারা জানেন, স্যার ক্লাসের শরুতেই বলতেন- ‘আমি কেউ না। আমার অর্ধেক আমার মায়ের আর অর্ধেক আমার বাবার’। এই যে বাবা মায়ের থেকে পাওয়া ক্রোমোজোম সেট নিয়ে আমাদের বিকাশ, তাদের যাবতীয় দোষ-গুণ-চরিত্র আমাদের মধ্যে- তারপরও আমরা হুবহু তাদের মত নই। স্বাতন্ত্র্যতা যেটুক পাই তা মুলতঃ পারিপার্শিক বিভিন্ন কারণে ক্রোমোজোম তথা জীন লেবেলের পরিবর্তনের কারণেই যা আমাদের মাঝে ভিন্নতা তৈরী করে দেয়

..........................................
মাহমুদা নাসরিন কাজল
mahmuda_nasrin@yahoo.com

সচলায়তনের লিংক--



Thursday, July 15, 2010

ঋষিকাপত্র. ১















শ্রাবণের কবিতা

ঋষিকাপত্র


সাহিত্যপত্র।
সংখ্যা : এক। শ্রাবণ ১, ১৪১৭ বঙ্গাব্দ।
সম্পাদক : মৌসুমী কাদের।
প্রকাশক : কুলদা রায়।


..........................................................
ফেসবুকে ঋষিকাপত্রের লিংক
..........................................................










সম্পাদকীয়

আজ বৃষ্টি ঝরছে। শুনছি, শাওনগগণে ঘোর ঘনঘটা। কণিকা কিন্নর কণ্ঠে গাইছেন। রাত্রি নয়--নিশীথ নেমে এসেছে। বজ্রবিদ্যুতের মধ্যে দিয়ে রাধা চলেছেন বনপথে। গাছপালা লটিয়ে আছে। প্রবল হাওয়ায় যমুনা ফুঁসে উঠেছে। কোথাও বাজছে বাঁশি। আর ঝরছে যুথিগন্ধ বৃষ্টি।
এই ছবিটি আমার শ্রাবণের। তবু শ্রাবণদিন চলে যায়। কেবল তার ছায়া পড়ে থাকে মনে--বনে।

এরকম শ্রাবণ নিয়ে কবিতা লিখেছেন ছয়জন কবি। প্রতিটি কবিতায়ই ভীন্নস্বর বাজে। শব্দের গায়ে মেঘ জমে। বৃষ্টি নামে।

আসুন, কবিতাশ্রাবণে ভিজি।


সূচিপত্র :

১. খোন্দকার আশরাফ হোসেন : ঘোর বর্ষা
২. ওবায়েদ আকাশ : ধীরেন্দ্র আর ভুশার নস্টালজিয়া, মুখর এলাহি কাল
৩. আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ : ছাতার নিচে-এক, ছাতার নিচে- দুই
৪. সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ : বৈরিক পত্রাবলি
৫. হিন্দোল ভট্টাচার্য : শ্রাবণভাষা
৬. তুষার গায়েন : মেঘ ঈশান নৈঋতকোণে

খোন্দকার আশরাফ হোসেনের কবিতা









ঘোর বর্ষা



বৃষ্টির ছাতা মাথায় নিয়ে নির্দ্বিধায় নেমে পড়ি রাস্তায়।
আর কোনো ভয় নেই, ভয়ের ডরটা পেরুতে পারলে।
অঝোর ধারাবর্ষণ এসে মুক্ত করে দিয়ে গেল আমাকে―
আহ্ শান্তি, আকাশজোড়া মুগ্ধ মানকচুর ছড়ানো পাতাটা
আমাকে রক্ষা করছে বৃষ্টিময়তার মধ্যে, ভিজিয়ে দিয়ে।

যে-মেয়েটি ট্রাফিক সিগন্যালে ফুল বেচে, ভিজছে সে-ও,
তার হাতে ধরা গোলাপের গোছা দুটো জল খেয়ে সতেজ;
এই তুমুল বৃষ্টির মধ্যে কেউ গাড়ির কাচ খুলবে না জেনেও
এসে দাঁড়াচ্ছে থেমে-যাওয়া গাড়ির পাশে, অভ্যাসমাফিক।

জল দাঁড়ায়ে গেছে টাকনু তক, পানির হালট ভেঙে ওপারে
হেঁটে গেলেন পাজামা-গোটানো এক মৌলবী সাহেব।
কালস্রোতে ভেসে যাওয়া ধনমান লক্ষ করে বিষণ্ন এক পাগল
ভেজা কাকের সাথে অঝোরে ভিজতে থাকে চৌমাথায়।

রমনার গাছগুলো শতাব্দীর ঘুম-ভাঙা কলহে মেতেছে
বাবড়ি চুলের সাথে দীর্ঘ কেশদাম লুটোপুটি হাওয়ায় হাওয়ায়
ঝরাপাতা সাঁতার কাটছে তেলাপিয়া মাছ, প্রেমপত্র,
পরিত্যক্ত ঠোঙার সাথে জীবনের শেষ চিকিৎসার হ্যান্ডবিল ।

এত প্রাণ এত দু:খ এত নিরাভরণ দীনতা ও ক্ষুধা
সব ঐ নিরন্ধ্র বৃষ্টির মধ্যে মনে হয় হারিয়েছে ধার
সবকিছু ক্লান্তির অপর পারে আবছায়া ধূসরতা মৃত্যুমলিনতা
ঢেকে রাখে ক্রোধ, প্রেম, অহোরাত্র কলহের মানকচুপাতা।



ঘন বর্ষার দিনে কাচারিঘরের মধ্যে নানান দৃশ্যের জন্ম,
বাঁশের চাঙারি বানাচ্ছে কেউ, ফুটে উঠছে ডেভিডের তারা চাচড়ের ক্রসবুনোটে
কোন এক নাজেহাল শহর ভ্রমণের গল্প বলছে হাতফেরতা হুঁকা
সেবার মাছের ঝাঁক উঠে এসেছিল আউশের ক্ষেতজুড়ে খণ্ডকালীন মাছুড়েরা বলে
টেটা বল্লম হাতে ওয়াটারলু’ যুদ্ধের স্মৃতি কয়েকজন প্রাক্তন সেনার।

এদিকে হৈ হৈ পাঁচটি কিশোর বাতাবিনেবুর ওয়ার্লডকাপে
কাকেরা ভেজা ডালের মোরাকেবায় প্রসন্ন, কেউ কেউ হীনযানী অতন্দ্রচাক্ষুষ
কাদার ভেতর থেকে উজানি কৈয়ের হৃদি করতলে ধরে যেন বুদ্ধের যৌতুক।

ঘনবর্ষার দিনে তাসের আসরে সব টুয়েন্টি-নাইন -রঙ কল্পনার ধনু
আছাড়ি-পিছাড়ি যায় কিষাণীর জলভেজা কষ্ট শাড়ি নিঙাড়ি নিঙাড়ি।

কারো-কারো মনে পড়ে কে যেন পদ্মার বোটে ভেসেছিল দূরদেশি বাবু
দেখেছিল ছাতিমের উদার পাতার নিচে ভিজছে পিতৃগৃহষ্ণেু নায়রী
এবার হলো না গান সাজাদপুরের হাটে বিষয়ীরা ডুবিয়েছে নাও
বেহদ্দ পানির দরে পাট বেচে ঘরে ফেরে উদাস লালন ।

৩.

আকাশের জলকরঙ্কবাহীরা সারি সারি দাঁড়ায়ে গিয়েছে
আর ঢালছে তাদের কুম্ভ থেকে জল,
নিচে মানুষের সাধ্যমত ঘরবাড়ি, ধানক্ষেত, পালানের নামিলা মরিচ
ভেসে যাচ্ছে পানিয়া ভরনে নদীতীর উথালিপাথালি যায়
বাইচের নৌকা আর কলার ভেলার চলে সমতুল নওরোজ, ফেটিবাঁধা
গায়েনের দোহার ধরেছে মালকোচা পরনে কিশোর
কচুরিপানার ঘূর্ণি ঢোঁড়াসাপের হৃদয় কাড়িছে
হেঁকে যায় বজ্রের চাবুক হাতে তুড়–ক সওয়ার
জলের সিন্ধুক খুলে কী কী রত্ন পাওয়া যায় দেখে নেয় জেলে
উপরে টিনের বাদ্য ঝমাঝম বৃষ্টির নাচুনি
থামালে কত্থক নাচ একটুখানি টুসকি দেয়ে সোনার ছেলেরা



কবি পরিচিতি
খোন্দকার আশরাফ হোসেন : কবি প্রবন্ধকার ও সম্পাদক--একবিংশ। প্রফেসর, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

ওবায়েদ আকাশের কবিতা















ধীরেন্দ্র আর ভুশার নস্টালজিয়া



‘ধিরে, সুখ নাই।’

[ভুশার একমাত্র ঘোড়াটি গতরাতে চুরি হয়ে গেছে।
কিংবা ধারণা করা যায়, এ মুষল বৃষ্টিতে ঘোড়াটির
দুরন্ত শৈশবের কথা মনে পড়ে যায়।]

‘কেন?’ --বলল ধীরেন্দ্র।

আবার ধীরেন্দ্র কয়, ‘তোর থেকে ত্রি-দন্ত চতুর কেউ
একজন ঘোড়াটির আজকাল খোঁজখবর নেয়।’

‘ধিরে, এখন কী করি?’

‘যত দূর জানা আছে, তার কিছু তথ্য বের করি।’

[তথ্যে বেরিয়ে পড়ে, এ ভরা শ্রাবণে, তিনিও ঘোড়ায়
চেপে হঠাৎই ছুটছেন নাকি সোমত্ত কৈশোরের দিনে।]

‘মাঝি, কোন ঘাটে ভিড়বে তোমার তরী?’

[নদীতীরে ধীরেন্দ্র আর ভুশা, তাদেরও শৈশবের দু’টি
টিকিট যদি মেলে!]


মাঝি বলে, ‘আপনারা ব্যাটা নাকি ছেলে?’

এ ওর দিকে চায়, তারপর ধীরেন্দ্র বলে--‘মুশকিলে
ভুশা, মাঝিও মনের কথা রঙ ধরিয়ে বলে।’



মুখর এলাহি কাল

একবার যখন ভালবাসতে শিখেছ, তেমাথার মোড়ে গাছগাছালির ভিড়ে নিঝুম বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে পড়ে দেখ-- ভালবাসা কেন বারবার বৃষ্টিতে ভিজে উঠতে চায়। থৈ থৈ বর্ষাকাল এলে চারিদিকে ভালবাসার চাষবাস যেমন বাড়ে, কণ্ঠে বিরহ তুলে কত নাইওর গ্রাম ছেড়ে ভিন গাঁয়ে যায়-- কত ঋষি কামার্ত হয় ভিজে!

পৌষ-মাঘে বৃষ্টি হলে তোমার আমার ভালবাসার দুর্ভোগ নেমে আসে-- যেভাবে আষাঢ়ে-শ্রাবণে-- তুমি আমি ফিরে পাই ছেলেবেলার স্মৃতি-- মুখর বর্ষণে। প্রতিদিন তোমার প্রতীক্ষায় যেমন থাকি, তেমনি অঝর বর্ষণের লোভে হাটুরের দলে ভিড়ে নদীর কিনারে বসে এটাওটা বিকিকিনি করি-- মাছবাজারে ঘুরি, বৃষ্টিতে লাফিয়ে-ওঠা খালুই ভর্তি মাছ কিনে ঘরে ফিরে অসি। যেহেতু আমার ভেতরে--পৃথিবীর তাবত বর্ষা মানেই দুর্দান্ত ছেলেবেলা, গাঁয়ের স্কুলমাঠে থৈ থৈ জলে ফুটবল নিয়ে খেলা। আজো অব্দি ভালবাসা মানেই যেমন বৃষ্টি বৃষ্টি এবং বৃষ্টি-- অন্যত্র বর্ষাকাল মানেই গুড়– গুড়– মেঘের গর্জনে ঘর ছেড়ে পালিয়ে বেড়ানো-- মুখর এলাহি কাল


* কবি পরিচিতি
ওবায়েদ আকাশ : কবি, সম্পাদক--শালুক ও সাময়িকী বিভাগ, দৈনিক সংবাদ। জন্ম ১৯৭৩।

আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহর কবিতা








ছাতার নিচে--এক

হাত ধরে আছি বাঁশপাতা কাপড়ের গম্বুজে
ধুম করে ঢুকে যাচ্ছে জলমর্মর পিচ্ছিল মাটিদেশ
নামছে মেঘপতনের আলো - আকাশের বিষ্ময়!
গুঁড়ি গুঁড়ি এই প্রীতিখণ্ড
বাতাস ধরে উঠছে কোন হিমালয়ে!

কালো মহিষের বেশে দৌড়াচ্ছে মানুষের ছায়া
পেছনে জড়ানো এই গ্রামদেশ কার বার্তা পাঠায়
কাকে জানায় অপহরণের ঘটনা?
নির্বিবাদী জলআক্রমণে শেষ হয় পাথরকুড়ানোর আশা
আর দূরে যাওয়ার যাতনা গলে যায়
এই ব্যাকুল মহিলার মৌসুমে।
নুয়ে আছি ছেলেদের লালবলে-
ভিজে যাওয়া গোলপোস্ট ধু ধু মাঠে,
নিজেকে হারাই- গোলাকার নিরাকার কক্ষপথে।

১২/০৭/২০১০


ছাতার নিচে-- দুই

ভাষার ব্যবহার ছোট হয়ে যায়
শরীরে জমে জলপাখি মেঘের পিঞ্জর
আসে প্রস্তরযুগ শিকারির ইশারা
দখল করছে কেউ
এই ব্রীজ পারাপার লেবুপাতার সংসার।

তরল পতনে নিজের পায়ে দাঁড়ানো দায়!
ধান দুর্বা ধুলি যাই দিই
আজ শুধু বিবতর্নের প্রাণ ছাড়া কিছুই নাই।
যদি সংশয়ে থাকো
তাহলে ছাতার ভেতরে আসো,
দেখে যাও নীলসবুজ সময়ের কামিজে
নীড়হারাদের ঠিকানা।

প্রতীক্ষার পালন শেষে জেগে উঠেছে মুহূর্ত
বৃষ্টি বৃষ্টি শাদা-সন্ত পায়রার দল দেবদূত
উড়ছে বাস স্টপ রেলের কামরায়।
নিহত সিপাহিদের দল
কালো কাপড়ে ঢেকে যায় রক্তপিপাসা।

১২/০৭/২০১০


কবি পরিচিতি
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ : কবি। শিক্ষক। অস্ট্রেলিয়ায় বসবাসরত। জন্ম : ১৯৬৫।

সুব্রত অগাস্টিন গোমেজের কবিতা








বৈরিক পত্রাবলি


(আমানউল্লাহ্, সোদরেষু)

বিষয় : Òবৃষ্টিÓ তথা তস্য উপমেয়

With beaded bubbles winking at the brim… (Keats)

প্রাক্কথন :
একদা আমানউল্লাহ্ 'বৃষ্টি' এই কথা উচ্চারিবামাত্র আমরা, অর্থাৎ বিষ্ণু বিশ্বাস, রতন দস্তিদার, সুরজিৎ দত্ত আর আমি এককাট্টা ভিজিবার উপক্রম করিতেই চণ্ডষণ্ডবৎ দৌড়িয়া আসিয়া যজ্ঞ পণ্ড করিল লুপিস...

ফুলচন্দন পড়ুক তোমার মুখে,
শিল্পী আমান! পৃথিবীর সব কবি
এ-উৎপ্রেক্ষা নিতই গোপনে টুকে :
বৃষ্টি - বৃষ্টি - বৃষ্টি - বৃষ্টি - অবি-
সংবাদী সুর, চরম - পরম ছবি!

শোণিতে মুক্তধারার মুক্তি-স্নান,
দেউলে-- দেউলে হঠাৎ আরতি-ধ্বনি!
হৃদয়ের মেঘ ঝঞ্ঝায় বেপমান,
ঊনপঞ্চাশ বাতাস ছত্রখান,
অকালবোধনে চরাচরে সিম্ফনি -

একটি পলকে ঢুকে গেল বারো মাস:
রমণীরও চেয়ে রমণীয় এই মণি!
এরই লাগি আমি ছেড়েছি হিরের খনি -
শির-দরিয়ার তলে - এই নটিলাস!
নাভির গভীরে জমাট নাভিশ্বাস!

Envoy :

আমান!
- জি?
শুনলাম ইদানীং ভালোই কামান?
- জি?
তাহলে চলুন ভিজি-
- আজ্ঞে
ওসব কি আর আছে মোদের ভাগ্যে...

(1991)



* কবি পরিচিতি
সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ : কবি, প্রাবন্ধিক, গল্পকার, অনুবাদক। অন্যতম সম্পাদক--অগ্রবীজ। অস্ট্রেলিয়ায় বসবাসরত। জন্ম ১৯৬৫।

হিন্দোল ভট্টাচার্যের কবিতা









শ্রাবণভাষা


ঝাপসা হয়ে আসছে চোখ, তোমাকে কীভাবে বলি
তোমার দিকেই আমি ক্রমশ শ্রাবণ!
শব্দে শব্দে মেঘ করে আসে...
ভিজে মাটির উপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে
একবুক শ্বাস
আমার প্রেমের মত ওঠে নামে, শান্ত সোঁদা মাটির ভাষায়

২.
আকাশে কান্নার মুখ ভার
নিচু মেঘ জানে না সে কীভাবে আষাঢ়
যেমন আমার মন
যেমন তোমার মন
ভীষণ একাকী...

আকাশে কান্নার মুখ ভার

৩.
যাব না কোথাও, এই শহরে মেঘের তাবু থেকে...
বলব না আমাকে নাও
আলো যত কমে আসে, আমারও বয়স ক্লান্ত হয়
এস তুমি আমাকে ভেজাও
অনেক মৃত্যুর গল্পে পুনরুজ্জীবনের কথা থাকে
শ্রাবণ, ভাসাও
বৃষ্টির ফোঁটা নিচে বুড়ো পাতা শেষ কয়েকদিন
যেমন ছটফট করতে থাকে



*
হিন্দোল ভট্টাচার্য : কবি। সহসম্পাদক--থিয়েটার ম্যাগাজিন স্যাস,কোলকাতা। জন্ম ১৯৭৭।